' বিধিনিষেধ'-এর নাম করে মে মাসের ১৫ তারিখ থেকে শুরু হওয়া লকডাউন পশ্চিমবঙ্গ সরকার ৩১ জুলাই অবধি বাড়িয়ে দিয়েছেন । কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গের ভ্রুকুটির পরিপ্রেক্ষিতে আরও কতদিন এই লকডাউন চলবে বা আরও বেশী কড়া ভাবে বলবৎ হবে কিনা তা বলা মুশকিল ।
ধীরে ধীরে বাস, অটো, মেট্রো ইত্যাদি সর্বসাধারণের জন্য চলতে শুরু করলেও স্টাফ স্পেশাল ছাড়া নিয়মিত লোকাল ট্রেন চলতে দেওয়ার ব্যাপারে রাজ্য সরকারের তীব্র অনীহা । কলকাতার লাইফলাইন এই শহরতলীর লোকাল ট্রেন পরিষেবা বিঘ্নিত থাকায় শহরের জনজীবন ও অর্থনীতি বিপর্যস্ত ।
কোভিড অতিমারীকে রোখার ক্ষেত্রে লকডাউন আদৌ কতটা কার্যকর তা নিয়ে বিভিন্ন মহলে শুরু থেকেই প্রশ্ন উঠেছে ।
অবশ্যই এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই যে লকডাউন করে সাময়িকভাবে সংক্রমণের হার অনেকটাই কমিয়ে আনা যায় । কোভিড মূলত হাঁচি, কাশি, কথাবার্তা, শ্বাসপ্রশ্বাসের মাধ্যমে ছড়ায় । ফলে লকডাউন হলে , অধিকাংশ মানুষ ঘরে থাকায়, একে অপরের সংস্পর্শে আসার সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে । তার ফলে অসুখের ছড়িয়ে পড়ার গতিও কমে যাবে । কিন্তু এই অসুখ এত সংক্রামক যে সংক্রমণ পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যাবে না । ভিতরে ভিতরে, ধীর গতিতে হলেও চলতে থাকবে । আর একবার লকডাউন তুলে নিলেই তা হু হু করে ছড়িয়ে পড়বে । যেমনটা আমাদের দেশে প্রথম তরঙ্গের সময় লকডাউন তুলে নেওয়ার পর দেখা গিয়েছিল । তাই কেন্দ্রীয় সরকারের বহু বিজ্ঞাপিত "breaking the chain of transmission" শেষ অবধি বাস্তবায়িত হয়নি।
যে সব বিজ্ঞানীরা লকডাউনকে সমর্থন করেছেন তাঁরাও কখনও একথা বলেননি যে লকডাউনের মাধ্যমে এই ভাইরাসকে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া যাবে বা এই অতিমারীকে শেষ করে দেওয়া যাবে ।
বরং লকডাউন করে সংক্রমণের হারকে সাময়িকভাবে অনেকটা কমিয়ে দিয়ে, সেই সময়টাকে কাজে লাগিয়ে, অতিমারীকে কার্যকরভাবে মোকাবিলা করার মতো স্বাস্থ্য পরিকাঠামো গড়ে তোলাই ছিল মূল উদ্দেশ্য ।
আসলে এই ধরনের মহামারীকে রোখার বৈজ্ঞানিক কৌশল হলো টেস্টিং , ট্রেসিং, আইসোলেশন এবং ট্রিটমেন্ট । অর্থাৎ প্রচুর মানুষের করোনা পরীক্ষা করে কোভিড পজিটিভ মানুষদের আইসোলেট করে রাখতে হবে । লক্ষণযুক্ত রোগীদের চিকিৎসা করতে হবে । পজিটিভ মানুষদের সংস্পর্শে যাঁরা এসেছেন তাঁদের কোয়ারেন্টিন করে রাখতে হবে এবং তাদেরও পরীক্ষা করাতে হবে । যদি কোনো একটা নির্দিষ্ট এলাকায় একসঙ্গে বহু মানুষ আক্রান্ত হয়ে পড়েন তাহলে সেখানে স্থানীয়ভাবে কন্টেইনমেন্ট জোন তৈরী করে সাময়িকভাবে মানুষজনের চলাফেরায় কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা যেতে পারে ।
কিন্তু শাসকরা ভারতকে যতই একটা আধুনিক, শক্তিশালী, উন্নত রাষ্ট্র হিসেবে তুলে ধরার চেষ্টা করুক না কেন , এই ধরনের কার্যকরী পদক্ষেপ নিয়ে অতিমারী ঠেকানোর ক্ষমতা এই দেশের বেহাল স্বাস্থ্য ব্যবস্থার নেই । তাই মানুষকে বোকা বানাবার জন্য লকডাউনকে সর্বরোগহারী ওষুধ হিসেবে তুলে ধরা শুরু হল । আমাদের দেশে সরকারের অবস্থা হয়েছে স্কুলের ফাঁকিবাজ ছাত্রের মতো । সারা বছর পড়াশোনা করে না।
যখন পরীক্ষা চলে আসে তখন কোনও উপায় না দেখে টুকলি করে পাস করতে চায়। আর ঈশ্বরের কাছে প্রার্থনা করে, যে প্রশ্নগুলো টুকলির চিরকুটে লিখে নিয়ে গেছে, সেই প্রশ্নগুলোই যেন পরীক্ষায় আসে।
বছরের পর বছর ধরে স্বাস্থ্যব্যবস্থার কোনো উন্নতি করেনি। করের অধিকাংশ টাকা যুদ্ধের মারণাস্ত্র, মূর্তি- মন্দির ইত্যাদি তৈরী করতে, নেতাদের আত্মপ্রচার আর দুর্নীতি করতে ব্যয় করেছে।
এখন যখন পরীক্ষা (কোভিড অতিমারী) শিওরে এসে দাঁড়িয়েছে, তখন তড়িঘড়ি লকডাউন (টুকলি) করে কোনোমতে সংক্রমণ ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা করেছে।
বলাবাহুল্য, টুকলিতে লিখে নিয়ে যাওয়া প্রশ্নগুলো পরীক্ষায় আসেনি।
অগত্যা ডাহা ফেল !
ভ্যাক্সিন নিয়ে এত বাগাড়ম্বর করার পরও ভ্যাক্সিন দেওয়ার ক্ষেত্রে ভারতের হার খুবই কম । বহু মানুষ রাত থেকে লাইন দেওয়ার পরও টীকা পাচ্ছেন না । তার ওপর ভ্যাক্সিন নিয়ে কালোবাজারি থেকে শুরু করে ভুয়ো ভ্যাক্সিন কান্ড তো আছেই ।
বাংলায়ও মমতা ব্যানার্জি প্রথমে বলেছিলেন লকডাউন করবেন না । কিন্তু পরে ' অশ্বত্থামা হত, ইতি গজ '-র মতো করে 'বিধিনিষেধ' জারী করে রেখেছেন ।
এই লকডাউনে উচ্চবিত্ত ও উচ্চ-মধ্যবিত্ত মানুষের বিশেষ অসুবিধা হয়নি । কিন্তু নিম্ন-মধ্যবিত্ত ও নিম্নবিত্ত শ্রমজীবী মানুষের জীবনে চরম বিপর্যয় নেমে এসেছে । তামিলনাডুর মতো দু'একটা রাজ্য ছাড়া ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের আর্থিক সাহায্য করার সেইরকম উদ্যোগ দেখা যায়নি । সরকার শুধু রেশনে বিনামূল্যে চালডাল সরবরাহ করে ক্ষান্ত । কিন্তু চাল, ডাল,আলু ছাড়াও যে মানুষের জীবনধারণের জন্য আরও অনেককিছুর প্রয়োজন হয় সেই ব্যাপারে বোধহয় আমাদের সরকারি নীতিনির্ধারকরা অজ্ঞ ।
যেকোনো পদক্ষেপ নেওয়ার আগে রিস্ক বেনিফিট রেশিও দেখেই সিদ্ধান্ত নেওয়া উচিত। অর্থাৎ সেই সিদ্ধান্তে কতখানি লাভ আর কতখানি ক্ষতি । এই লকডাউনের ফলে যে দেশের অধিকাংশ মানুষেরই লাভের থেকে ক্ষতি বেশী হয়েছে তা বলাই বাহুল্য । কিন্তু সরকার তা দেখেও না দেখার ভান করে আছে ।
একইসঙ্গে লকডাউনের ফলে সব রঙের শাসকদের আরো একটা বড়ো সুবিধা হয়েছে । বিধিনিষেধের কারণে মিটিং মিছিল ইত্যাদিতে নিষেধাজ্ঞা থাকার সুযোগে নানা জনবিরোধী আইন পাশ করিয়ে নিচ্ছে । নানা জনবিরোধী নীতি প্রণয়ন করে নিচ্ছে। আর কেউ প্রতিবাদ করলেই বিপর্যয় মোকাবিলা আইনে গ্রেফতার বা গ্রেফতার করার হুমকি ।
যদিও এইসব নিয়মকানুন শুধুমাত্র বিরোধীদের জন্য । শাসক দল দিব্বি বিভিন্ন জায়গায় জমায়েত করে নানা রাজনৈতিক কার্যকলাপ চালাচ্ছে । বিনা পুলিশী বাধায় ।
কোভিডের তৃতীয় তরঙ্গ আসন্নপ্রায় । ইতিমধ্যেই পৃথিবীর অনেক দেশে তৃতীয় ঢেউ শুরু হয়ে গেছে । আমাদের দেশ বা রাজ্যও এ থেকে মুক্ত থাকবে এমন আশা করাও বাতুলতা । তবে এবার যেন অবৈজ্ঞানিক লকডাউনের যথেচ্ছ ব্যবহারের বদলে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে, ভ্যাক্সিন এবং চিকিৎসার মাধ্যমে, কার্যকরীভাবে এই ভয়ঙ্কর অতিমারীর মোকাবিলা করা হয়, সরকারের কাছে এই দাবী জোরালোভাবে তুলতে হবে।
Comments
Post a Comment