আফগানিস্তানের তালিবান মূলত একটা সামন্ততান্ত্রিক শক্তি । পাশতুন অধ্যুষিত এলাকার বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী ও সামন্তপ্রভুরা হল এদের শ্রেণী ভিত্তি । যে উগ্র ইসলামি মৌলবাদী মতাদর্শে এরা বিশ্বাস করেও সেটাও একটা সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শ ।
সেই তালিবান কী করে একটা দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে পারে ? আজকের পৃথিবীতে বুর্জোয়ারাও এত বেশী প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেছে যে কোনো উপনিবেশ বা আধা-উপনিবেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের নেতৃত্ব দিতে সক্ষম নয় । কোথাও শ্রমিক শ্রেণীর নেতৃত্বে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম হলে সেই দেশের জাতীয় বুর্জোয়াদের একটা অংশ তাতে অংশগ্রহণ করতে পারে বড়োজোর । ঐতিহাসিক বস্তুবাদ আমাদের এই শিক্ষাই দেয় যে সমাজ বিকাশের ইতিহাসে সামন্ততন্ত্রকে ধ্বংস করে পুঁজিবাদ এসেছে । পুঁজিবাদ পরবর্তীকালে প্রতিক্রিয়াশীল হয়ে গেলেও সামন্ততন্ত্র সব সময়ই পুঁজিবাদের থেকে প্রতিক্রিয়াশীল থাকে । সেই কারণেই পুঁজিবাদের থেকে প্রগতিশীল শ্রমিক শ্রেণীর মতাদর্শ মার্কসবাদ দিয়েই তার বিরুদ্ধে লড়তে হয় । সামন্ততান্ত্রিক মতাদর্শ দিয়ে হয় না ।
ইতিহাসের চাকা উল্টোদিকে ঘোরে না ।
সেই অবস্থায় তালিবানের মতো একটা চরম প্রতিক্রিয়াশীল , সামন্ততান্ত্রিক শক্তি কীভাবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বিরুদ্ধে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম করল ? এবং জয়ীও হয়ে গেল !!
আজকের দিনে যে কোনো দেশে সামন্ততন্ত্র টিকে থাকে সাম্রাজ্যবাদের অধীনে । সাম্রাজ্যবাদের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল হয়ে । সাম্রাজ্যবাদের ভিত্তি হিসেবে কাজ করে সামন্ততন্ত্র । যেরকম আমাদের দেশেও দেখতে পাওয়া যায় । তাই সমস্ত আধা-উপনিবেশিক দেশেই সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী সংগ্রাম এবং সামন্ততন্ত্র-বিরোধী সংগ্রাম একে অন্যের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িত । নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবের দুটো দিক থাকে । জাতীয় বিপ্লব এবং গণতান্ত্রিক বিপ্লব ।
আফগানিস্তানেও তালিবান চীন, রাশিয়া সহ বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির ( বিশেষ করে সামাজিক সাম্রাজ্যবাদী চিনের) তাঁবেদারি করেই ক্ষমতায় এসেছে । যেরকম একসময় মার্কিন সাম্রাজ্যবাদের দালালি করেছিল । মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চিন এবং রাশিয়া – এই তিন সাম্রাজ্যবাদী শক্তির লড়াইয়ে তালিবান একটা বোড়ে ছাড়া কিছুই নয় । যাঁরা তালিবানের মধ্যে সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী, প্রগতিশীল ভূমিকা খোঁজার চেষ্টা করছেন, তাঁরা একটু ভেবে দেখবেন ।
অনেকে একথা বলতে পারেন যে, পৃথিবীর নানা দেশে নানা ধর্মীয় মতাদর্শ ভিত্তিক সংগঠন তো জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম করেছে এবং এখনও করছে । যেমন লেবাননের শিয়া সংগঠন হেজবুল্লাহ তার আদর্শ উদাহরণ । ঠিকই বলেছেন। কিন্তু হেজবুল্লাহর কার্যকলাপ বা তার নেতাদের বক্তব্য গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে আমরা দেখতে পাব যে তাঁরা শিয়া ধর্মভিত্তিক সংগঠন হলেও তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ইসরায়েল ও আমেরিকার বিরুদ্ধে লড়াই করে লেবাননকে মুক্ত করা । তাঁরা সারা লেবানন জুড়ে শরিয়া আইনের ভিত্তিতে কোনও শিয়া ধর্মীয় রাষ্ট্র গড়তে চান না । বরং লেবাননের সুন্নি মুসলিম ও ম্যারোনাইট ক্রিশ্চিয়ানদের সাথে মিলে একটা বহুধর্মীয় রাষ্ট্র গঠনই তাঁদের লক্ষ্য ।
ঠিক যেমন ভারতের স্বাধীনতা সংগ্রামে যে স্বদেশী বিপ্লবী সংগঠন অংশগ্রহণ করেছিল তাদের অধিকাংশের ওপরই হিন্দু ধর্মীয় মতাদর্শের কমবেশি প্রভাব ছিল । কিন্তু , বঙ্কিমচন্দ্রের আনন্দমঠের দ্বারা প্রভাবিত হলেও ভারতকে স্বাধীন করে হিন্দুরাষ্ট্র তৈরী করা তাদের প্রায় কারোরই লক্ষ্য ছিল না । ভারতকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের কবল থেকে মুক্ত করাই তাঁদের মূল উদ্দেশ্য ছিল ।
অন্যদিকে তালিবানের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন সাম্রাজ্যবাদী দেশের দালালি করে আফগানিস্তানের ক্ষমতায় টিকে থেকে শরিয়া ভিত্তিক এক ইসলামি রাষ্ট্র ( ইসলামি আমিরশাহী ) তৈরী করা । আফগানিস্তানে যা হচ্ছে তা এক প্রতিক্রিয়াশীল গৃহযুদ্ধ ছাড়া কিছুই নয় । সেই প্রতিক্রিয়াশীল গৃহযুদ্ধকে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে পরিণত করা, সাম্রাজ্যবাদ-বিরোধী, সামন্ততন্ত্র-বিরোধী নয়াগণতান্ত্রিক বিপ্লবে পরিণত করাই এখন আফগানিস্তানের বিপ্লবী শক্তির কাছে
প্রধান কর্তব্য । একটা বড় চ্যালেঞ্জ ।
Comments
Post a Comment