Skip to main content

লক্ষীর ভান্ডার - অনুদান বনাম অধিকার

নির্বাচন পূর্ববর্তী প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর বহু প্রচারিত 'লক্ষীর ভান্ডার' প্রকল্পটি শুরু করে দিয়েছেন । রাজ্যের মহিলারা প্রতি মাসে ৫০০ টাকা করে পাবেন,  সরকারের কাছ থেকে । তফশিলি জাতি ও উপজাতিভুক্ত এবং অন্যান্য অনগ্রসর শ্রেণীর মহিলারা পাবেন ১০০০ টাকা ।  সরকারি কর্মচারী বা পেনশনভোগীদের বাদ দিয়ে ২৫ থেকে ৬০ বছরের মধ্যে প্রায় সব মহিলাই এই সুবিধা নিতে পারবেন । 

  শেষ তথ্য পাওয়া অবধি  ১ কোটি ৮০ লক্ষেরও বেশী মহিলা এই প্রকল্পে নাম নথিভুক্ত করেছেন। সারা রাজ্য জুড়ে লক্ষীর ভান্ডারে নাম লেখানোর লাইনে বিশৃঙ্খলা, পদপিষ্ট হয়ে আহত হওয়ার ঘটনা, নিয়মিত সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশ হচ্ছে ।

  যথারীতি রাজ্যের শাসক দল এবং বিরোধী দলগুলির মধ্যে এই নিয়ে তরজাও শুরু হয়ে গেছে। 

  বিরোধীরা দাবী করছেন,  রাজ্যের মানুষের অর্থনৈতিক অবস্থা এতই খারাপ যে মহিলারা মাত্র ৫০০ টাকার জন্য ভিখারীর মতো হয়ে গেছেন ।  ভিক্ষার রাজনীতি করে জনগণের আনুগত্য কিনছে তৃণমূল । আবার শাসকদলের মতে, এই ধরনের সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে সাধারণ মানুষের জীবনের হাল ফিরিয়ে দিয়েছে এই সরকার । তাই লক্ষীর ভান্ডার নিয়ে এত উৎসাহ মহিলাদের মধ্যে । 

  যুক্তি দিয়ে দেখতে গেলে লক্ষীর ভান্ডার, যুবশ্রী, রূপশ্রী, স্বাস্থ্যসাথী ইত্যাদি কোনোটাই ভিক্ষা নয়। কারণ মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর নিজের ব্যক্তিগত টাকা থেকে বা দলের কোষাগার থেকে এই অনুদান দিচ্ছেন না । সরকারী অর্থে দিচ্ছেন। যেটা জনগণের করের টাকা ।  তাহলে জনগণের টাকা জনগণের হাতে গেলে তা ভিক্ষা হয় কী করে ? 

  কিন্তু মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় রাজনৈতিক জনসভা সহ বিভিন্ন জায়গায় যেভাবে এইসব প্রকল্পের প্রচার করেন এবং মানুষের জন্য 'এতকিছু' করে দেওয়ার পরেও কেন কিছু মানুষ আরও দাবীদাওয়া জানাচ্ছেন,  তা নিয়ে অসন্তোষ প্রকাশ করেন, তাতে বোঝা যায় যে তিনি নিজে এগুলোকে একধরণের ভিক্ষা দেওয়ার মতোই মনে  করেন । 

  আবার অন্যদিকে এই প্রকল্পগুলোকে জনগণের অধিকার হিসেবে চিহ্নিত করাও কঠিন ।  সাধারণত অধিকার তাকেই বলা হয় যা “রাষ্ট্র মানুষকে দিতে দায়বদ্ধ” বলে পৃথিবীর অধিকাংশ দেশেই স্বীকৃত । যেমন জীবিকার অধিকার, শিক্ষা, স্বাস্থ্য , বাসস্থানের অধিকার ইত্যাদি । যে অধিকার না থাকলে মানুষ তার জন্য সংগ্রাম করে ।  আর থাকা অবস্থায় কেউ কেড়ে নিতে চাইলে তা রক্ষার জন্য লড়াই করে । কিন্তু এই কন্যাশ্রী, যুবশ্রী, রূপশ্রী বা লক্ষীর ভান্ডার যখন ছিলনা তখন কি এইসবের দাবীতে কোনও আন্দোলন হয়েছিল ?  বা আজ যদি এই প্রকল্পগুলো বন্ধ করে দেওয়া হয় তাহলে এগুলো পুনরায় চালুর দাবীতে বিশাল কোনও আন্দোলন হবে বলেও মনে হয় না । কারণ জনমানসে সার্বজনীনভাবে এগুলো  'অধিকার' বলে স্বীকৃত নয় ।

  তবে আসল প্রশ্নটা হলো,  এই সমস্ত প্রকল্প সাধারণ মানুষের জীবনধারণে আদৌ কোনও উন্নতি ঘটাতে পারছে কিনা । 

  বহু বছর ধরেই পশ্চিমবঙ্গের অর্থনীতির হাল ক্রমশ খারাপ হয়েছে । সরকারী চাকরির সুযোগ কমে গেছে । সংগঠিত শিল্পে কাজের সুযোগ কমে গেছে । অধিকাংশ মানুষকেই ক্ষুদ্র ব্যবসা, পরিবহন এবং অন্যান্য পরিষেবা ক্ষেত্রে প্রবল অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার মধ্যে কোনোরকমে জীবনধারণ করতে হচ্ছে । ৩৪ বছরের সিপিএম আমলের অবস্থা ১০ বছরের তৃণমূল আমলেও কিছুই বদলায়নি । 

  কৃষিতে বিপুল উন্নতির 'গল্পের' পরেও গ্রামবাংলা থেকে লাখ লাখ তরুণকে ভারতের নানা রাজ্যে জনমজুরি খাটতে যেতে হয় ।  তথ্য-প্রযুক্তি শিল্পের বিকাশের ঢালাও 'প্রতিশ্রুতির' পরেও মধ্যবিত্ত পরিবারের হাজার হাজার ছেলেমেয়েদের ব্যাঙ্গালোর, হায়দ্রাবাদ ইত্যাদি জায়গায় চাকরির খোঁজে যেতে হয় । 

  সিপিএম আমলে কৃষক উচ্ছেদ করে, কৃষিজমি দখল করে, জলের দরে টাটা-সালেমদের হাতে তুলে দিয়ে 'উন্নয়নের' নাটক করা হয়েছিল ।  কিন্তু জনগণ সহজেই সেই 'উন্নয়নের' নাটকের আসল স্বরূপ ধরে ফেলেন ।  হাজার হাজার একর উর্বর কৃষিজমি দখল করে , হাজার হাজার কৃষিজীবী ও কৃষির ওপর অপ্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল মানুষের জীবিকা কেড়ে নিয়ে যে কারখানা তৈরী হয় সেখানে কাজ হারানো মানুষদের দশভাগের এক ভাগ লোকেরও কর্মসংস্থান হয় না । তাও বাইরে থেকে আসা দক্ষ শ্রমিকরাই সেখানে বেশী কাজ পায় ।  তাই রাজ্যের মানুষ এই অপউন্নয়নকে নাকচ করে তৃণমূলকে ক্ষমতায় আনেন । 

  তবে মমতা সিপিএমের মতো একই ভুল করেননি। তিনি অন্য কৌশল অবলম্বন করেন ।  তিনি মানুষের মধ্যে কর্মসংস্থানের অভাবজনিত ক্ষোভকে প্রশমন করার জন্য বিভিন্ন সামাজিক প্রকল্পের মাধ্যমে অনুদানের রাজনীতি শুরু করলেন  । একদিকে সরকারী অর্থে নানারকম অনুদান প্রকল্প দিয়ে বহু মানুষকে তুষ্ট করে রাখা হয় ।  আর অন্যদিকে যাঁরা চাকরির দাবীতে আন্দোলন করছেন সেইসব যুবক-যুবতীদের ভাগ্যে জোটে পুলিশের লাঠি ,  একের পর এক মামলা আর জেলের গরাদ । 

  শুধু এই রাজ্যে নয়, সারা পৃথিবী জুড়েই নানা দেশে,  এমনকি ভারতেও বহু রাজ্যে,  শাসকশ্রেণী এই ধরণের স্টিক এ্যান্ড ক্যারট বা লাঠি এবং মূলোর কৌশল নিয়েছে জনগণের ক্ষোভকে দমিয়ে রাখার জন্য । 

  সেই সঙ্গে স্থানীয় স্তরে এইসব প্রকল্প রূপায়ণের সময় তৃণমূল স্তরের নেতাদের ঘুষ,কাটমানি সহ নানাধরণের দূর্নীতির সুযোগ করে দেওয়া তো আরেকটা উদ্দেশ্য । সেটা অন্য এক বৃহৎ আলোচনার বিষয় হতে পারে । 

  তাই যে সব মানুষ বাধ্য হয়ে এইসব অনুদান প্রকল্পের সুবিধা নিচ্ছেন,  তাঁরা ভিক্ষা করছেন বলে তাঁদের ছোট করা যেমন উচিত নয়, ঠিক তেমনই এইসব অনুদানের মাধ্যমে জনগণের জীবনের যে কোনও সদর্থক পরিবর্তন যে হবে না তাও খুব স্পষ্ট করে বুঝে নেওয়া দরকার । 

  রুটি-রুজির দাবীতে , চাকরি ও অন্যান্য কর্মসংস্থানের দাবীতে দুর্বার আন্দোলন গড়ে তোলাই এখন সময়ের দাবী। 



Comments

Popular posts from this blog

ন্যায্য দাবীতে আন্দোলনরত বাংলাদেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আক্রমণকে ধিক্কার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের যে ভূমিকা ছিল, তার থেকে অনেক বেশী ভূমিকা ছিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি , পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(এম-এল)'এর মত বিপ্লবী দলগুলোর । এমনকি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) প্রথমে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করলেও পরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল । এইসব বিপ্লবী দলগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই করেছিল । বরিশাল, পাবনা, যশোর সহ আরও নানা জায়গার যুদ্ধ তার প্রমাণ।  এই কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠনগুলোর লড়াইয়ের ফলেই স্বাধীন, নয়াগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হত। হয়ত কয়েক বছর দেরী হত।   দক্ষিণ এশিয়ায় সাচ্চা কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনায় ভীত হয়েই সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, তার দালাল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে ব্যবহার করে, আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে পূর্ব বাংলার তথাকথিত এই 'স্বাধীনতা'র জন্ম দেয় । 'বাংলাদেশ' নামটার ও জন্ম হয় । আসলে বিপ্লবীরা  স্বাধীন 'পূর্ব বাংলা' রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছিলেন। তার বদলে এল আধা-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশ।   তার পরেই এল মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চর...

আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস দীর্ঘজীবী হোক

আজ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস।  আজকের দিনে বহুক্ষেত্রেই উত্তর-আধুনিক দর্শন এবং তা থেকে উদ্ভুত আইডেন্টিটি পলিটিক্স নারী আন্দোলনের ওপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করেছে।  শ্রেণী সংগ্রাম তথা সর্বহারার বিপ্লবের সঙ্গেই যে নারী মুক্তি সংগ্রাম অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পৃক্ত তা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।  বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তথা সুবিধাবাদকে প্রতিষ্ঠা করাই অনেক ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক তথাকথিত বা স্বঘোষিত বিপ্লবী নারী সংগঠন  বা ব্যক্তিও এই বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হতে পারেননি।  নারী আন্দোলন মানে হলো নারী এবং পুরুষের দ্বন্দ্ব । এরকম হাস্যকর, ভ্রান্ত, অনৈতিহাসিক  চেতনাও অনেকের মধ্যে গেঁড়ে বসেছে।  এই রকম পরিস্থিতিতে কমরেড ক্লারা জেটকিনের জীবন ও শিক্ষাকে গভীরভাবে অনুধাবন করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ।  কমিউনিস্টরা নারী মুক্তি আন্দোলন বলতে যা বোঝেন, তার সঙ্গে তথাকথিত নারীবাদ নামক বিভিন্ন ধারার আন্দোলনের মধ্যে যে শ্রেণীচরিত্রগত পার্থক্য আছে তা উপলব্ধি করতে হবে।  এমনকি 'সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ' বা 'মার্কসবাদী নারীবাদ...

ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে ছাড় দেওয়া যাবে না

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-শহরে মানুষের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।  সিপিএম আমলের শেষদিকে সিপিএমের বিরুদ্ধে যেরকম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল,  অনেকটা সেরকমই।  অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এবং বহু মধ্যবিত্ত মানুষ তৃণমূলের  দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সরাসরি শিকার হয়েছেন।  স্বভাবত, তৃণমূলকেই তাঁরা সবচেয়ে বড়ো শত্রু হিসেবে দেখছেন।  পশ্চিমবঙ্গে কোনওদিন বিজেপির শাসন ছিল না।  তাই আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস এই রাজ্যের মানুষ কখনও সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করেননি।  তাই হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর রূপ সম্বন্ধে তাদের সম্যক ধারণা ও উপলব্ধি নেই।  অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সারাদিন নিজেদের রুটি-রুজির সন্ধানে ব্যাস্ত থাকেন। তাই টিভি বা খবরের কাগজ খুলে, উত্তর প্রদেশে বা গুজরাটে বিজেপি সরকার কী সন্ত্রাস চালাচ্ছে বা আদানি কী ভাবে দেশের সম্পদ লুঠ করছে, তা জানা বা বোঝার অবকাশ তাঁদের নেই।   তাঁদের চোখের সামনে বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁরা যা দেখছেন সেটাই তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড়ো :বাস্তব'।  আর সেই 'বাস্তবে' তৃণমূলই সবচেয়ে বড়ো শয়তান।  বহু ক্ষেত...