Skip to main content

জনগণের অর্থে 'রাজনৈতিক মোচ্ছব'

দুর্গাপুজোর প্রায় একমাস আগে থেকেই মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দোপাধ্যায় পুজোর উৎসব  শুরুর ঘোষণা করে দিলেন । এটা এই রাজ্যে নতুন কিছু নয় ।  ক্ষমতায় আসার পর থেকেই কারণে-অকারণে একের পর এক মেলা, উৎসব ইত্যাদির আয়োজন করে তিনি আপামর রাজ্যবাসীকে মাতিয়ে রেখেছেন ।
গত দু'বছরের তুলনায় এবার কোভিডের প্রকোপও কম ।  তাই ফুর্তির অন্ত নেই । 
তবে কোভিড এবং লকডাউন পরবর্তী সময়ে অসংখ্য মানুষের যখন নুন আনতে পান্তা ফুরোচ্ছে,  চারদিকে একটা চাকরি পাওয়ার জন্য হাহাকার চলছে,  বহু মানুষ অভাবে জ্বালায় আত্মহত্যা করছেন  - তখন এই অতিরিক্ত আনন্দ-উৎসবের আয়োজন এক নির্মম পরিহাস ছাড়া আর কিছুই নয় । 
রাজ্যের এই কঠিন অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতেও ৪৩,০০০ ক্লাবকে দুর্গাপুজো করার জন্য ৬০,০০০ টাকা করে অনুদান দেওয়া হচ্ছে।  গত বছরের থেকে ১০,০০০ বেশী । এর উদ্দেশ্য একটাই।  বিভিন্ন ছোট বড় ক্লাবের সাথে যে অসংখ্য স্থানীয় যুবক যুক্ত থাকে, তাঁদের নিজেদের পক্ষে রাখা ।  এদের দিয়েই ব্রিগেড বা ২১শে জুলাই সমাবেশে লোক যোগাড় করা থেকে শুরু করে ভোটের সময় 'ভোট ম্যানেজ'(পড়ুন রিগিং) করা থেকে গ্রামে বা শহরের পাড়ায় পাড়ায় বিরোধীদের 'টাইট দেওয়া' - সবই করা হয় । 
এদের হাতে কাঁচা টাকা তুলে দিয়ে মদ গাঁজার নেশা ধরিয়ে,  অশ্লীল নাচগানের জলসার আয়োজন করে,  ভোগবাদী বুর্জোয়া, লুম্পেন সংস্কৃতির অবাধ প্রসার ঘটানো হয় । সুস্থ সংস্কৃতির চর্চাকে ব্যহত করা হয় ।
আগে শহরাঞ্চলে এগুলো দেখা যেত ।  এখন গ্রামাঞ্চলেও ব্যপক ভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই লুম্পেন সংস্কৃতি । 
সিপিএমের আমলেও,  নিজেদের রাজনৈতিক স্বার্থে কাজে লাগানোর জন্য,  পাড়ার ক্লাবের ছেলেদের হাতে রাখার কৌশল চালু ছিল।  কিন্তু তখন মূলত সিপিএমের কোনও নেতা বা সিপিএম ঘনিষ্ঠ কোনও প্রমোটার বা ব্যবসায়ী দ্বারা  ক্লাবে রঙিন টিভি  কেনার টাকা দেওয়া বা ক্লাবের ছেলেদের পিকনিক করার টাকা দেওয়া ইত্যদির মধ্যে সীমাবদ্ধ ছিল । 
কিন্তু এখন যেভাবে সরকারি কোষাগারে,  জনগণের অর্থ থেকে এই মোচ্ছবের টাকা যোগানো হচ্ছে তা সেইসময় দেখা যেত না । 
নিন্দুকদের মতে,  বর্তমানে তাঁর দলের একের পর নেতা যেভাবে দুর্নীতির অভিযোগে অভিযুক্ত হচ্ছেন, গ্রেফতার  হচ্ছেন,  চারদিকে তৃণমূল নেতা দেখলেই "চোর চোর" রব উঠেছে,  দলের ভিতরেই তাঁর পালটা গোষ্ঠীর উদ্ভব হওয়ার কথাও শোনা যাচ্ছে - সে সব কিছুকে সামাল দেওয়ার এটাও একটা কৌশল।
একই সঙ্গে ধর্মীয় সংখ্যাগুরু অনুভুতিকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করার ক্ষেত্রে বিজেপির সঙ্গে পুরোদস্তুর প্রতিযোগিতায় তিনি নেমে পড়েছেন ।  বিজেপি দীর্ঘদিন ধরে প্রচার করে এসেছে যে তৃণমূল  ধর্মীয় সংখ্যালঘু মুসলিমদের তোষণ করে।   পশ্চিমবঙ্গে নাকি  হিন্দুরা বিপদে আছেন ।  এই রাজ্যে নাকি দুর্গাপুজো করা যায় না।
বিজেপির এইসব প্রচারের পালটা নিজেকে হিন্দুদের প্রতিভু, হিন্দুদের রক্ষাকারী হিসেবে তুলে ধরার প্রচেষ্টাও এর মধ্যে আছে।  যাতে ২০২১ এর বিধানসভা নির্বাচনে যে হিন্দু ভোট বিজেপির দিকে গিয়েছিল,  তার কিছুটা অংশ নিজের দিকে ফিরিয়ে আনা যায় ।  
একটা সেকুলার রাষ্ট্রে,  সরকারি কোষাগার থেকে কোনও ধর্মীয় উৎসবের জন্য এইভাবে দেদার টাকা অনুদান দেওয়া যায় কিনা তা নিয়ে এখন রাজনৈতিক কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ কেউই আর প্রশ্ন তোলেন না ।  ব্যাপারটা এতটাই গা-সওয়া হয়ে গেছে । 
দুর্গাপুজো বাঙালি হিন্দুদের সবচেয়ে বড় উৎসব । অবশ্যই ধর্মপ্রাণ মানুষ তা ধুমধাম করে পালন করবেন ।  কিন্তু সরকারি অর্থে পুজোয় মোচ্ছব করে আসলে এই ধর্মীয় উৎসবকে নিজের এবং নিজের দলের স্বার্থে ব্যবহার করে নেওয়া হচ্ছে।  সেকুলার, প্রগতিশীল মানুষদের মধ্যে থেকে যেমন এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ধ্বনিত হওয়া উচিত,  তেমনই ধর্মপ্রাণ হিন্দুদেরও উচিত এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদে গর্জে ওঠা । 
কারণ এটা ধর্মীয় উৎসবের আবরণে  সরকারি অর্থে একটা 'রাজনৈতিক মোচ্ছব'। 

Comments

Popular posts from this blog

ন্যায্য দাবীতে আন্দোলনরত বাংলাদেশের সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের ওপর স্বৈরাচারী আওয়ামী লীগ সরকারের আক্রমণকে ধিক্কার

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে আওয়ামী লীগের যে ভূমিকা ছিল, তার থেকে অনেক বেশী ভূমিকা ছিল পূর্ব বাংলার সর্বহারা পার্টি , পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি(এম-এল)'এর মত বিপ্লবী দলগুলোর । এমনকি পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টি (এম-এল) প্রথমে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতা করলেও পরে সরাসরি মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেছিল । এইসব বিপ্লবী দলগুলো পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও রাজাকার, আল-বদর বাহিনীর সঙ্গে মরণপণ লড়াই করেছিল । বরিশাল, পাবনা, যশোর সহ আরও নানা জায়গার যুদ্ধ তার প্রমাণ।  এই কমিউনিস্ট বিপ্লবী সংগঠনগুলোর লড়াইয়ের ফলেই স্বাধীন, নয়াগণতান্ত্রিক বাংলাদেশের জন্ম হত। হয়ত কয়েক বছর দেরী হত।   দক্ষিণ এশিয়ায় সাচ্চা কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখলের সম্ভাবনায় ভীত হয়েই সোভিয়েত সামাজিক সাম্রাজ্যবাদ, তার দালাল ভারতীয় সম্প্রসারণবাদকে ব্যবহার করে, আওয়ামী লীগকে সামনে রেখে পূর্ব বাংলার তথাকথিত এই 'স্বাধীনতা'র জন্ম দেয় । 'বাংলাদেশ' নামটার ও জন্ম হয় । আসলে বিপ্লবীরা  স্বাধীন 'পূর্ব বাংলা' রাষ্ট্রের জন্য লড়াই করেছিলেন। তার বদলে এল আধা-ঔপনিবেশিক বাংলাদেশ।   তার পরেই এল মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে চর...

আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস দীর্ঘজীবী হোক

আজ আন্তর্জাতিক শ্রমজীবী নারী দিবস।  আজকের দিনে বহুক্ষেত্রেই উত্তর-আধুনিক দর্শন এবং তা থেকে উদ্ভুত আইডেন্টিটি পলিটিক্স নারী আন্দোলনের ওপর ব্যপক প্রভাব বিস্তার করেছে।  শ্রেণী সংগ্রাম তথা সর্বহারার বিপ্লবের সঙ্গেই যে নারী মুক্তি সংগ্রাম অঙ্গাঙ্গী ভাবে সম্পৃক্ত তা ভুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা চলছে।  বুর্জোয়া ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ তথা সুবিধাবাদকে প্রতিষ্ঠা করাই অনেক ক্ষেত্রে নারী আন্দোলনের মূল লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে। অনেক তথাকথিত বা স্বঘোষিত বিপ্লবী নারী সংগঠন  বা ব্যক্তিও এই বিচ্যুতি থেকে মুক্ত হতে পারেননি।  নারী আন্দোলন মানে হলো নারী এবং পুরুষের দ্বন্দ্ব । এরকম হাস্যকর, ভ্রান্ত, অনৈতিহাসিক  চেতনাও অনেকের মধ্যে গেঁড়ে বসেছে।  এই রকম পরিস্থিতিতে কমরেড ক্লারা জেটকিনের জীবন ও শিক্ষাকে গভীরভাবে অনুধাবন করা অত্যন্ত প্রয়োজন হয়ে পড়েছে ।  কমিউনিস্টরা নারী মুক্তি আন্দোলন বলতে যা বোঝেন, তার সঙ্গে তথাকথিত নারীবাদ নামক বিভিন্ন ধারার আন্দোলনের মধ্যে যে শ্রেণীচরিত্রগত পার্থক্য আছে তা উপলব্ধি করতে হবে।  এমনকি 'সমাজতান্ত্রিক নারীবাদ' বা 'মার্কসবাদী নারীবাদ...

ফ্যাসিস্ট বিজেপির বিরুদ্ধে লড়তে গেলে দুর্নীতিগ্রস্ত তৃণমূলকে ছাড় দেওয়া যাবে না

পশ্চিমবঙ্গের গ্রামে-শহরে মানুষের মধ্যে তৃণমূলের বিরুদ্ধে প্রচন্ড ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে।  সিপিএম আমলের শেষদিকে সিপিএমের বিরুদ্ধে যেরকম ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল,  অনেকটা সেরকমই।  অধিকাংশ শ্রমজীবী মানুষ এবং বহু মধ্যবিত্ত মানুষ তৃণমূলের  দুর্নীতি ও সন্ত্রাসের সরাসরি শিকার হয়েছেন।  স্বভাবত, তৃণমূলকেই তাঁরা সবচেয়ে বড়ো শত্রু হিসেবে দেখছেন।  পশ্চিমবঙ্গে কোনওদিন বিজেপির শাসন ছিল না।  তাই আরএসএস-বিজেপির হিন্দুত্ব ফ্যাসিস্ট সন্ত্রাস এই রাজ্যের মানুষ কখনও সামনাসামনি প্রত্যক্ষ করেননি।  তাই হিন্দুত্ব ফ্যাসিবাদের ভয়ঙ্কর রূপ সম্বন্ধে তাদের সম্যক ধারণা ও উপলব্ধি নেই।  অধিকাংশ সাধারণ মানুষ সারাদিন নিজেদের রুটি-রুজির সন্ধানে ব্যাস্ত থাকেন। তাই টিভি বা খবরের কাগজ খুলে, উত্তর প্রদেশে বা গুজরাটে বিজেপি সরকার কী সন্ত্রাস চালাচ্ছে বা আদানি কী ভাবে দেশের সম্পদ লুঠ করছে, তা জানা বা বোঝার অবকাশ তাঁদের নেই।   তাঁদের চোখের সামনে বা প্রত্যক্ষ অভিজ্ঞতায় তাঁরা যা দেখছেন সেটাই তাঁদের কাছে সবচেয়ে বড়ো :বাস্তব'।  আর সেই 'বাস্তবে' তৃণমূলই সবচেয়ে বড়ো শয়তান।  বহু ক্ষেত...